দুর্গাপুজোর সাত কাহন
সাত কাহন
এক
মতামত
দুর্গাপূজার সময় সারণি তৈরী হয় দু'টি পঞ্জিকার কোনো একটিকে অনুসরণ ক'রে। এক,গুপ্তপ্রেশ পঞ্জিকা,আর এক,বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। দু'টি পঞ্জিকা দু'টি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে তিথি নির্ণয় করে ফলে,তাঁদের গণনায় কিছু ফারাক থাকে ফলস্বরূপ,আমরা দু'রকম সময় নির্ঘন্টে দুর্গাপুজো হ'তে দেখি। ব্যতিক্রম বোধহয় এই বছরেই হ'ল যে, দু'টি পাঁজিতেই এবার আশ্বিন মাসকে মলমাস ব'লে নির্ণয় করা হয়েছে।
পূজা পদ্ধতির সঙ্গে পাঁজির কোনও সম্পর্ক নেই। পূজা পদ্ধতির ক্ষেত্রে 'দেবীপুরাণ',' 'বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ','কালিকা পুরাণ', এমনই কোনো একটি উপপুরাণকে মান্যতা দেওয়া হয়। পূজা পদ্ধতির ক্ষেত্রেও তাই বিভিন্নতা দেখা যায়।
দুই
কলাবৌ
কলাবৌ গণেশের বৌ নয়। কলাবৌকে বলা হয় নবপত্রিকা। এটা একটা স্বতন্ত্র গ্রামীণ লোক ধর্মের প্রতিরূপ। দুর্গামণ্ডপে এই লোকধর্মের আগমনে দুর্গাপুজো অন্য মাত্রা পেয়েছে। ন'টা ওষধি গাছকে ন'রাত্রি ধ'রে নানান আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করার রীতি রাঢ় বাংলার মূলবাসী শবরদের মধ্যে পালিত হ'ত। এখনও অনেক জায়গায় হয়। ভেষজ গুণকে বতর্মানে দুর্গার শক্তি রূপেই পুজো করা হয়। এখনকার প্রচলিত মন্ত্র- "নবপত্রিকাবাসিন্যৈ ভগব্দুর্গায়ৈ নমঃ"। ভেষজ গুন সম্পন্ন ন'টা গাছ হ'ল......
রম্ভা(এক)
কলাগাছ অর্থাৎ রম্ভা। এই গাছের সঙ্গে ছোট গাছ হ'লে পুরো গাছ,বড় গাছ হ'লে তার সতেজ ডাল দিয়ে নবপত্রিকা তৈরী করা হয়। বাকী আটটা গাছ হ'ল-
হলুদ গাছ(দুই)
ধানগাছ(তিন)
কালো কচু(চার)
মান কচু(পাঁচ)
অশোক (ডাল)(ছয়)
দাড়িম্ব বা ডালিম গাছ/ডাল(সাত)
জয়ন্তী (ডাল)(আট)
বিল্ব (বেল,ডাল সহ একজোড়া ফল)(নয়)
এই সব গাছ বা ডালগুলোকে শ্বেত অপরাজিতার লতায় বাঁধা হয় কলা গাছের সঙ্গে(যদিও মজবুতির জন্য পাটের দড়িও ব্যবহার করা হয়)।
শ্বেত অপরাজিতা
তিন
সর্বৌষধী ও মহৌষধী
নবপত্রিকাকে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে স্নান করানো হয়। পুরাণ ভেদে সেই উপকরণগুলোর মধ্যে কিছু ভিন্নতা আছে কিন্তু সর্বৌষধী সে ক্ষেত্রে 'কমন'। সর্বৌষধী তৈরী হয় ন'টি ভেষজ উপাদান দিয়ে।
মুরামাংসি
কুড়
শৈলেয়(শিলাজিৎ)
হরিদ্রা
দারুহরিদ্রা
শটী
চম্পক
মুথা
মহৌষধী সাধারণত এক রকমের হয় না। বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন ভেষজকে মহৌষধী বলা হয়েছে কিন্তু মৎস্য পুরাণে মহাস্নানের জন্যই নির্দিষ্ট করা হয়েছে যে মহৌষধী,তার নির্দিষ্ট আটটা উপাদান আছে।
সহদেবী
কন্টিকারী
হলুদ বেড়েলা
শ্বেত বেড়েলা
শঙ্খপুষ্পী
বাসক
ক্ষীরকাকোলী
অতসী
গাছগুলির প্রতিটা অংশেরই আলাদা আলাদা ভেষজগুণ আছে যদিও এই নির্দিষ্ট মহৌষধী তৈরী করার ক্ষেত্রে এই গাছগুলোর কোনো নির্দিষ্ট অংশের উল্লেখ নেই।
আরও একটা লক্ষনীয় যে অঞ্চলভেদে গাছগুলোর চেহারায় ভিন্নতা দেখা যায়।
চার
সন্ধিপূজা
বৈদিক যুগ থেকেই দু'টি সময়ের সন্ধিক্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হ'য়েছে। কখনো তা দুই ঋতুর সন্ধি,কখনো দুই তিথি,কখনো তা সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা,আবার কখনো দুই পক্ষ। দুর্গাপুজোর সন্ধি পুজোতেও দু'টো তিথির সন্ধিকে বিশেষ গুরূত্ব দেওয়া হ'য়েছে।ঋগ্বেদের যুগে হিম বৎসর গণনা করার কালে শরৎ ঋতুর শেষ ও শীত ঋতুর শুরুর সন্ধিক্ষণকে রুদ্র যজ্ঞের মধ্যমে বরণ করা হ'ত। পরবর্তীতে সেই ধারা বিভিন্ন পুরাণ ও উপপুরাণগুলোতে অনুসরণ করার প্রবণতা লক্ষণীয়।
নববর্ষকে আলোকজ্জ্বল ক'রে,নতুন বস্ত্রে সেজে পালন করার রীতিকেই আজ ঘরের মেয়ে উমার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। পৌরাণিক ব্যাখ্যায় তা কখনও অসুরকে বধ করার চূড়ান্ত মূহুর্তকে মূর্ত করে,কখনও তা রাবণকে বধ করার ক্ষণকে। সন্ধিপুজো এখানেই খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের এক পরম্পরাকে ঋদ্ধ করে। ঋগ্বেদের কালের যে রুদ্র যজ্ঞ সেখানেও ঋতু পরিবর্তন কালের ব্যাধি নাশ করার ও নতুন বছরকে স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ করার বাসনাই থাকত।
পাঁচ
কুমারীপূজা
দুর্গাপুজোর অষ্টমী কিংবা নবমী তিথিতে,মূল পুজোর সমান্তরালে,এই পুজোটা একটা সম্পূর্ণ পুজো হিসেবেই অনুষ্ঠিত হয়। বৈদিক যজ্ঞে যজ্ঞাগ্নিকে কুমারী রূপে ব্যাখ্যা করার বহু নমুনা পাওয়া যায়। আবার তথাকথিত অনার্য সংস্কৃতিতেও কুমারীদেরকে নানান আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকৃতি জানানোর পরম্পরা আছে।
দুর্গাপুজো কালে কালে এক ধর্মীয় সংস্কৃতির মিলনস্থল হ'য়ে উঠেছে। কুমারীপুজো যেন তারই সাক্ষ্য বহন ক'রে চলেছে।
ছয়
বিজয়া দশমী
দশমী তিথি দুর্গাপুজোয় বিশেষ উপাধিযুক্ত হ'য়ে,আমাদের হাতে লোভনীয় 'প্লেট' ধরিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা বৈদিক যদি না-ও হয়, প্রাচীন ঐতিহ্য বটে। সূর্যের উত্তরায়ণ যুদ্ধের কাল,দক্ষিণায়নের প্রারম্ভে বিজয়ী রাজাদের সর্বজনীন বিজয়োৎসব পালন,অস্ত্রপূজা,মিঠাই বিতরণ,ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্যের এক স্বীকৃত আচার। দুর্গাপুজো সূর্যের দক্ষিণায়নকে সূচিত করে।
প্রতিমা বিসর্জন শেষে,আমরা জনে জনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হ'য়ে, গুরুজনদের পদস্পর্শ ক'রে প্রণাম জানিয়ে,শুধু পরম্পরাকেই স্বীকৃতি জানাই না, আমাদের ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্যকেও আমাদের প্রণতি জানাই।
সপ্তম কাহন
দুর্গা কে?
শেষের শুরুতে বলি দুর্গা(দুর্+গম্+ড,ঢে,আপ্)দূর্গা নয়।
আর যাঁর অনবদ্য গ্রন্থ 'পূজা-পার্বণ' এই লেখার অনুপ্রেরণা, সেই গ্রন্থকার প্রাতঃস্মরনীয় আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি'র উদ্ধৃতি দিয়ে শারদীয় উৎসবকে প্রাণের প্রণতি জানাই।
আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি
দুর্গা দুর্গা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন