রকিং চেয়ার
রকিং চেয়ার
নদীর পাড়ে যেতে রাস্তার মাঝপথেই পড়ে জায়গাটা।
শিরীষ তলা, কেউ কেউ বলে খিরিস তলা। এলাকাটার বেশ পরিচিতি হয়েছে। বিশাল শিরীষ গাছের
তলায় ঘেঁষাঘেঁষি করে অনেকগুলো পুরনো আসবাবের দোকান গজিয়ে উঠেছে। বিপুল বাবু
প্রতিদিন বিকেল হ’লে নদীর পাড়ের আড্ডায় যেতেন। ওখানে গঙ্গা দেবীর থানে বয়স্কদের
একটা আড্ডা বসে। এখন লকডাউনে বন্ধ। লকডাউন না থাকলে সমবয়সীদের সঙ্গে বিকেলটা
গঙ্গার ধারেই কাটে। যাতায়াতের পথে এই পুরনো আসবাবগুলোকে একবার ক’রে চোখ বোলানো
বিপুলবাবুর এক সাম্প্রতিক অভ্যাস। লকডাউন শিথিলের এক বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে একটা
রকিং চেয়ারে হঠাত বিপুল বাবুর চোখ আটকে গেল। পুরনো মেহগিনি পালিশের জায়গায় জায়গায়
ঘষা ভাব। তবে বেশ আভিজাত্য আছে। এই রকম একটা চেয়ারের বাসনা হয়তো একদিন তাঁর ছিল
ব’লে সেই সময় মনে হ’ল। হাজারো চাহিদা আর অভাববোধের হিজিবিজিতে কবে সেটা হারিয়ে
গিয়েছিল।
বেশী বয়সের একমাত্র সন্তান কোম্পানীর সেলস
ম্যানেজার হ’য়ে বাইরে থাকে। মাসে দু’তিন বার বাড়ি আসত। এখন তাও বন্ধ। টাকা
পাঠায়,এখন একটু কম। নিজের যৎসামান্য পেনসন। দুই বুড়ো-বুড়িতে নিরালা নিরিবিলি জীবন।
দক্ষিণের বড় জানলার সামনে এই সঙ্গীটিকে বেশ লাগবে…….। এমনই হাজারো ভাবনার মধ্যে দিন কতক কাটল। এরই
মাঝে একদিন হাফ-বন্ধ দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে দোকানদারকে খোঁজার চেষ্টা করছেন এমন
সময় মাঝবয়সী একজন এগিয়ে এল। প্রাথমিক দরদাম ক’রে ইচ্ছেপূরণের সম্ভাবনাটা একবার
বুঝে নিলেন। বাড়িতে ফিরে গিন্নিকে ইচ্ছেটার কথা শোনালেন। রকিং চেয়ার গিন্নির কাছে
নতুন শব্দ। চেয়ারটিতে তাঁর আগ্রহ কেবল বাবুর মানে ছেলের কোনও কাজে লাগবে কিনা। ঘরে
তেমন আসবাব কোনও দিনই ছিল না। আসবাব বাড়ি সবই পুরনো আমলের। ছেলেটা এখানে যখন থাকে
তখন তার যদি কোন কাজে লাগে……।
লকডাউনের মাঝেই একদিন চেয়ার এল। পূর্ব পরিকল্পনা মতো তার স্থান হ’ল
দক্ষিণের বড় জানলার সামনে। বিপুলবাবুর স্ত্রী’র মনে হ’ল, বাবুর ছোটবেলায় এমনই দোল-খাওয়া
একটা কাঠের ঘোড়া ছিলো। বিপুল বাবুর সকাল-সন্ধেটা এখন জানলার সামনে এই চেয়ারেই কেটে
যায়। লকডাউনে যেদিন ক’রে ছাড় থাকে,বন্ধুদের মধ্যে ফোনাফুনি ক’রে তিন-চার জন
জুটলে,আড্ডাটা হয়। চেয়ার কেনার কথাটা তিনি একদিন আড্ডায় পাড়লেন। সকলেই বিপুলবাবুর
লাভ-লোকসানের একটা আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা চালালেন। স্বল্পভাষী বিপুলবাবু ঐ সব
হিসেবের আলোচনায় না ঢুকেও বুঝতে পারলেন,তিনি বেশ লাভই করেছেন। চেয়ার সূত্রে আলোচনা
গড়িয়ে গেল আর এক দিকে। বিপুলবাবু শুনলেন, হরিহর চ্যাটার্জীর বাড়ির পুরনো আসবাব দিন
কয়েক আগে বিক্রী হ’য়েছে। হরিহর চ্যাটার্জী,এক কালের প্রতিপত্তিশালী ব্যাক্তি।
দু’পুরুষ পর সে দিন গত। বিশাল বাড়ি অযত্নে ভগ্নদশা। শরিকী ভাগ-বাটোয়ারায়
নাতি-নাতনীদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশী। ঐ বাড়ির কোনও পরিবারই তেমন স্বচ্ছল
নয়। এই লকডাউনের বাজারে ওদের কেমন অবস্থা…….। বিপুল বাবু উঠে পড়লেন। ভেতরে কেমন একটা অস্থির ভাব লাগছে।
বাড়ি ফিরে বিপুল বাবু চেয়ারটার দিকে একবার তাকালেন। কিন্তু বসতে ইচ্ছে করল
না। আগের মতো খাটের ওপরই ব’সে পড়লেন। কি মনে হ’ল, স্ত্রীকে একবার ডাক দিলেন। তিনি
এই সময়ে সাধারণতঃ পরের দিন সকালের জন্য ফুল তুলে রাখেন। বিপুল বাবুর এমন অসময়ের
তলবে শারিরীক অসুস্থতার কথাই তাঁর মনে এলো। তাঁর সশব্যস্ততা দেখে বিপুল বাবু তাঁকে
আশ্বস্ত করলেন বটে,কিন্তু তিনি যে নিজেকে
কিছুতেই স্থির রাখতে পারছেন না, এটাও বুঝতে পারলেন। বললেন,’’চেয়ারটা শুধুশুধু কেনা
হ’ল। ফালতু টাকা নষ্ট।
কেন, চেয়ারটার কি হ’ল?
কিছুই না। এখন তো টাকা পয়সা
কম….ছেলেটাও বাইরে…. কি করছে……ওদের ওখানে কি অবস্থা...এদিকে
টিভিতে যা দেখাচ্ছে…….
কথাগুলো ঠিক সাজিয়ে উঠতে পারলেন না। গিন্নীও ঠিক বুঝে উঠতে না পেড়ে নিজের
কাজে চলে গেলেন। বিপুল বাবুও থাকতে বললেন না,ঘরের মধ্যে যেন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের
আওয়াজ কানে এলো। উতস ঠিক করতে পারলেন না। এমনিই চেয়ারটার দিকে চোখ গেল…….পয়সা দিয়ে কি কারও দীর্ঘ নিঃশ্বাস কিনে আনলেন?
------------------
👌👌🤘🤘
উত্তরমুছুনধ্ন্যবাদ
মুছুন