ভয়ঙ্কর একা

               ভয়ঙ্কর একা

বিষ্টু বামুনের ছেলে মদন। লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাবার পুজো করার এই জীবিকাটা মদনের পছন্দ ছিল না। সারাদিনই বাড়িতে লোকজনের আসা যাওয়া ছিল। বাড়িতে এসে লোকজন খুব সম্মান দিয়েই বাবার সঙ্গে কথা ব'লত কিন্তু বাইরে বাবার নামে বদনামও কম শোনেনি। 'বিষ্টু বামুনের খুব খাঁই', 'ও মন্তর-টন্তর কিছু জানে না'.....এমন অনেক কথাই মদনের কানে মাঝে মধ‍্যে আসে। বাবাকে ব'লতেও পারে না সে সব কথা। সে জানে,বাবার পুজো-আচ্চা করাতেই তাদের সংসার চলে। তার লেখাপড়াও বাবার যজমানির টাকাতেই হয়। সে তার বাবাকে একজন আড়ম্বরহীন সাদামনের লোক ব'লেই দেখে এসেছে। সারাদিন বাবা ব‍্যস্ত থাকে। কখনও পুবের বাদা থেকে কেশে তুলে আনছে তো কখনও পাঁজি নিয়ে বসছে.....। মদনের সবচেয়ে ভালো লাগে,বাবা যখন ঠাকুর দেবতার সেবা নিয়ে নানারকম কথা বলে। কখনও আপন মনে,কখনও বা মা'র সঙ্গে। কার বাড়িতে তুলসীপাতা বেছে দেয় না, কার বাড়ির বিগ্রহের শীতের পোষাক ছেঁড়া.....এই সব নিয়ে বাবা যখন কথা বলে,তখন মনে হয়,জ‍্যান্ত কোনও মানুষকে অবহেলা করা নিয়ে ক্ষোভের কথা বলছে। মদন কখনও এসব নিয়ে মথা ঘামায় না কিন্তু বাবার এই কথাগুলো বেশ ভালো লাগে। বাবা এই যে মূর্ত্তিগুলোকে সচল, জ‍্যান্ত হিসাবে ভাবে এবং তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিও যে তার একটা নজর আছে,এই ব‍্যাপারটার মধ‍্যে মদন তার বাবার নিপাট সরলতা খুঁজে পায়।
এই পারিবারিক জীবনের অনুসঙ্গেই মদনের একটা নিজস্ব জগৎ আছে আর সেই জগতে সে ভীষণ একা। কোনও সঙ্গই তার মনে বেশী প্রভাব ফেলতে পারে না। বাবা-মা'র একমাত্র সন্তান হওয়ায় ভাই-বোনের সঙ্গ কেমন তা সে জানে না আবার বাবা-মা এমনই সংসার অন্ত প্রাণ যে,তাদের সঙ্গে অন‍্য কোনও কথাও চলে না। এমনকি,তার লেখাপড়ার দিকটাও তাকেই দেখে নিতে হয়। বাবাকে শুধু পড়া বা বইখাতার খরচটা জানিয়ে দিলে,সুযোগ সবিধে মতো দিয়ে দেয়। ওই পর্যন্তই।
সেদিন মদন বাড়িতে সন্ধেবেলা পড়তে বসার তোড়জোড় করছে এমন সময় তার মা তাকে রান্নাঘরে ডাকল। মদন দেখল তার মায়ের মুখটা কেমন যেন ফ‍্যাকাসে হ'য়ে গিয়েছে। অত‍্যন্ত ভয় পেলে যেমন হয়। মদন কিছু বলার আগেই তার মা ফিসফিসিয়ে উঠল,'মালতি এসেছিল, আবুর কিছু একটা হ'য়েছে,তুই যেন আর বাইরে যাস না।' আবু মদনের পাশের পাড়ার ছেলে। সমবয়সী। ছোটবেলার বন্ধু। কোভিডের কারণে অনেক দিন দেখা নেই। ফোনে কয়েকবার কথা হয়েছিল। মা'র কথায় মদন কেমন ন'ড়ে গেল। সে কোনও কথা না ব'লে এক লাফে রান্নাঘরের দাবা থেকে উঠোনে পড়েই লাগালো দৌড়। যখন খেয়াল হ'ল,দেখ'ল,আবু একা একটা ছোট্ট ঘরে মেঝেতে শুয়ে আছে। ঘরে শুধু সে আর আবু। আবুর মা'য়ের কান্নায় মদন দরজার বাইরে দে'খল,উল্টো দিকের দাবায় আবুর মা একা ব'সে। উঠোনে রাস্তার আবছা আলোয় জনা চার লোকের মধ‍্যে আবুর বাবা। একজন চাপা স্বরে উদ্বেগে ব'লে উঠল,'এঃ,ভেতরে ঢুকলে কেন?' মদন আস্তে আস্তে উঠোনে নেমে এল। আবুর বাবা কিছু ব'লতে যাচ্ছিল,অন‍্য একজন ব'লল,'আমাদের কিছু করার নেই। থানা থেকে লোক এসেছিল,ওরাই যা করার করবে। তুমি  বাড়ি চলে যাও।'
আবুর কি টেস্ট  হ'য়েছিল?
আবুর বাবা যা ব'লল,সপ্তাহ খানেক আগে ওর বাবার ফ‍্যাক্টরিতে ওর হাতে  একটা চোট লাগে,যন্ত্রনাটা কমছিল না,দোকান থেকে ওষুধ এনে খাচ্ছিল। এর মধ‍্যে ওর গায়ে র‍্যাসও বেরচ্ছিল,বলা সত্বেও,ডাক্তার দেখাতে গা করেনি।কাল বলেছিল জ্বর জ্বর ভাব,আজ ডাক্তারের কাছে যাবার কথা ছিল,সকাল থেকে শ্বাসের কষ্ট শুরু হয়। চেষ্টা ক'রেও কোথাও অক্সিজেনের ব‍্যবস্থা করা যায়নি।

এলাকায় কারও মৃত‍্যু হ'লে এমন ফাঁকা, নিস্তব্ধ পরিবেশ মদনের অভিজ্ঞতায় প্রথম। আসার পথে ল‍্যাম্পপোস্টের আলোয়  সারা এলাকাটাকে কেমন ভয়াল শান্ত লাগছে। তার চেনাজানা পরিবেশটাই হারিয়ে গিয়েছে। রাস্তার ধারের সমস্ত বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ। ভেতরে আলো জ্বলছে কিন্তু মানুষজন আছে ব'লে মনে হচ্ছে না। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। রাস্তার পাশের পুকুর থেকে একটা জলঢোঁরা নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হ'ল। দু'পাশের ঝোপগুলো থেকেও বিচিত্র সব আওয়াজ আসছে। তবু ভীষণ নিস্তব্ধ চারিধার। দূর থেকেই দেখা গেল বাবা-মা দু'জনেই উঠোনে দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই চাপা গলায় মা হাঁ-হাঁ ক'রে উঠল।
দুম্ ক'রে তুই চলে গেলি?
আবুটা মরে গেল মা।
তুই ওখানে গেলি কেন?
বাবা ইতিমধ‍্যে সাবান,গামছা,ডেটল নিয়ে এগিয়ে এল 'স্নান ক'রে নাও।' মা গরম জল ক'রতে গেল।মদন চুপচাপ কলতলায়। চারদিকের নিস্তব্ধতাটা অসহ‍্য লাগছে। মা গজগজ করতে করতে বালতিতে গরম জল ঢেলে দিল। 
বড্ড ঠান্ডা লাগছে কিন্তু গায়ে তো মালুম হ'চ্ছে না! বাবা,মা তোর দিকেই তাকিয়ে ব'সে......মনে হ'চ্ছে,ওরা অনেক দূরে। তুই আর নাগাল পাবি না।তুই তো সাবান মাখছিস তবু মনে হ'চ্ছে অন‍্য কেউ তোর শরীর নাড়াচাড়া ক'রছে। গামছা দিয়ে মুছছিস,যেন আপাদমস্তক ঢাকা প'ড়ে গেল। দুনিয়াটা এতটাই চুপ মেরে গেল! তোর শরীরটা নাগারে ন'ড়ে যাচ্ছে। মা আগেই রান্নাঘরে,বাবা উঠে ঘরে গেল.......তোর হাত-পা স্বাভাবিক তবু,সারা শরীরে গাড়ির ঝাঁকুনি। ভীষণ ফাঁকা একা লাগছে। একা হওয়ার অনুভূতি এতটা ভয়াল হ'তে পারে! বারন্দার চেয়ারে ব'সেই মনে হ'ল ঝাঁকুনিটা থামল। চারদিক শুনশান তবু,মনে হ'চ্ছে কারা যেন কিছু বলাবলি করছে। মা'র গলা মাঝে মাঝে.....
পাড়ার লোক জানতে পারলে,যজমান বাড়িতে তোর বাবাকে ঢুকতে দেবে?......হঠাৎ তোর কি হ'ল?......কানে শুনেই লাফিয়ে দৌড়ে গেলি?......এই অন্ধকারে তোর যদি কোনও অঘটন ঘটত!......এই সময় কেউ কোনও মরার বাড়িতে যাচ্ছে?

শরীরে আবার ঝাঁকুনি লাগল। থেমে গেল। ঘরে উঠে গেলি তবু শরীরটা কেমন স্থির লাগছে। জানলার পাশে পড়ার চেয়ার টেবিল,পাখা ঘুরছে,আলো জ্বলছে,তবু ঘরটা ফাঁকা লাগছে। চোখের সামনে সব,তারে জামা প‍্যান্ট ঝুলছে,ক‍্যালেন্ডার দুলছে,ঘড়ি.......ঘড়িটা দেখে কিছুই বোঝা গেল না। মা'র ঝাঁঝ তখনও......
তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়। কি যে একটা কাজ করলি! পাড়ার কেউ দেখ'ল কিনা  কে জানে!

তুই কিছু খেতে পারবি না। ব'সে থাকতে থাকতে শুয়ে পড়লি,সারা শরীর আড়ষ্ট হ'য়ে আছে। উঠে বসলি,ভয় হ'চ্ছে? অসহায় লাগছে। এখনও মনে হ'চ্ছে সারা শরীরটা যেন ঢাকা। শরীরটা কেউ টান মেরে.....আবার স্থির.....আবার একটানা ঝাঁকুনি। আ  বু  রে....কেউ চিৎকার করল? আবার নিস্তব্ধ। ঘড়িটা দেখলি কিন্তু মাথায় ঢুকছে না। ব'সে থেকেও শুয়ে আছিস। পাস ফিরে শুয়ে পড়লি তখনও পিঠে বিছানাটা লেগে র'ইল। ঝাঁকুনিটা কখন থেমে গেছে। মুখের কাছে কতকগুলো হাতের নাড়াচাড়া...মুখটাও আবার যেন ঢাকা প'ড়ে গেল। আবার একটা হ‍্যাঁচকা টান। শরীরটা থেকে থেকেই ওঠা নামা করছে,যেন শূন‍্যে নাচছে। হঠাৎ হড়কে যেন অনেকটা নীচে নেমে গেল। মা তো ঘরে ঢুকলো......
দেখ,খেল না,ঘুমিয়ে পড়ল।
থাক ডেকো না। আলো অফ ক'রে দাও।
আজ এর কি যে হ'ল......

অন্ধকার। যখন আলো জ্বলছিল তখনও এমনই মনে হচ্ছিল। শরীরে এতো চাপ লাগছে কেন? মা কি গায়ে ভারী কিছু চাপা দিল! না! গা তো ফাঁকা,তাহ'লে এত চাপ.......ঘুমিয়ে পড়। নিঃসঙ্গ,একাকী,নিস্তব্ধ ঘুম। ঘুমও এত অশান্তির হয়! জেগে ওঠা কি সময়ের অপেক্ষা,সে কি অনন্ত?
                    __________________

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দুর্গাপুজোর সাত কাহন

আলয়

এসপার-ওসপার