প্রতীক্ষার পুজো

 

প্রতীক্ষার পুজো


কমল কাকা আমার জন্যে ব’সে আছে। এক সঙ্গে খাবে। বেলা বেড়েছে, মা ফোন করেছিল।….কমল কাকা, আমার প্রথম চাকরীটা ক’রে দিয়েছিল। মা কৃতজ্ঞ। আমাদের বিশাল বড় ফ্যামিলির এক রকমের কাকা। আমার সঙ্গে কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই। কমল কাকাই সতর্ক ক’রে দিয়েছিল,সেই প্রথম চাকরীর প্রথম কোম্পানির পার্টিতে। অনেক দিন আগে। মা জানে না। কথাটা হঠাৎ মনে এল। মদ স্মৃতিপথকে ভেজায়। দুর্গা পুজোর ক’দিন এই ভাবেই কাটে। ভাল লাগে। ফোনটা সুইচ অফ করলাম। এতক্ষন বন্ধুরা সব ছিল। যে যার বাড়ি গেল। স্নান খাওয়া ঘুম সেরে সন্ধে বেলা ওদের সপরিবার ঠাকুর দেখা। আমার সে পাট ঘুচে গেছে। ওরা রাতে সব আসবেএই ক’দিনের জন্য সারা বছরের অপেক্ষা। এমন নিশ্চিন্তে মদ খাওয়া দুর্গা পুজো ছাড়া সম্ভব হয় না। প্রচুর স্টক। বন্ধুরা মিলে করা হয়। যার যখন যত খুশি মদ খাও। খাচ্ছিও। সর্বজনীনে ভোগ নেওয়ার জন্য ডাকছে। কানুর গলা। সকাল থেকে রাত্রি, কানু একাই সব ঘোষণার দায়িত্বে। কানুরও নিশ্চয় সারা বছরের প্রতীক্ষা থাকে এই ক’টা দিনের জন্যে। সব পাড়াতেই এমন এক একজন থাকে। মাইক-হ্যাংলা ব’লে প্যাঁকও খেতে হ’য়। কিন্তু মাউথ-পিস দেখলেই এদের মাথার ঠিক থাকে না। আমার যেমন মদে।

এই ঘরটা সারা বছর বন্ধ থাকে। আমাদের মস্ত বাড়ির আর পাঁচটা ঘরের মতো। ঘরগুলোও হয়তো সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকে,লোকসঙ্গের। পুজোর সময় প্রায় সব ঘরেই লোক এসে যায়। এই ঘরটায় কেউ আসে না। নাম কোঠাঘর। বার-বাড়ির তিন তলার ছাদে বেশ বড়সড় চিলেকোঠা। বেশ কয়েক বছর ধ’রে,পুজোর সময়, আমার জিম্মাতেই ঘরটা থাকে। পুজোর ক’দিন বাড়ি ভর্ত্তি লোক। সবাই সব জানে, কিছু ব’লে না। আমাদের বাড়ির পুজো নিয়েই সব ব্যস্ত থাকে। আমার সঙ্গে পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই। মা বিরক্ত হয়।  চুপচাপ থাকি। বন্ধুরা মিলে ক’দিন আনন্দে থাকি। তারাও অপেক্ষায় থাকে এই ক’টা দিনের জন্য।

দরজায় আওয়াজ। আমি তো কারো অপেক্ষায় নেই! দরজা খুললাম না। বেশ কয়েক বার আওয়াজ হ’ল,থেমে গেল। এক সময় মাঝরাতে এই রকম আওয়াজ হ’ত। মা ঘুমিয়ে পড়তে বলত,পরের দিন সকাল সকাল বেরতে হ’ত কিনা! এই রকম আওয়াজ শুনে শুনে সে আমার বুক থেকে নেমে চ’লে গিয়েছে। মা বলেছে, ওর নাম মনেও আনবি না। আমিও তার প্রতীক্ষাতে নেই। সে  মাকে নিয়ে যা নয় তাই ব’লেছিল। বোঝাতে পারিনি। ……দরজা বন্ধই র’ইল। মায়ের দরকার হ’লে নাম ধ’রে ডাকবে। এবার সোডা দিয়ে খাব। সোডা মদকে বোঝে। বুঝে বুজগুড়ি মারে। নিয়ম মতো, এখন আর মদের স্বাদ পাচ্ছি না। সোডা দিয়ে শুরু করা উচিৎ ছিল। এই সময়টা খুব ভালো লাগে। শুধুই বর্তমান। কত শব্দ কানে আসছে, মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখছি, শুধু দেখছি- পাখা ঘুরছে, জানলা দিয়ে রোদ্দুর প’ড়েছে মেঝেতে। দেখলাম ব’লে কিছু নেই, দেখব ব’লে কিছু নেই। ঘটমান বর্তমান পর্যন্ত আমি খাই। চোখ-কান-নাক-মাথা সব অবশ। হাত-পা সব কোথায়? শুধু দেখছি, আড়াআড়ি খালি গ্লাস। বোতলের তলানিতে চোখটা আটকে। দরজায় শব্দ। ঘন ঘন। অনেক লোকের গলা। সবই বাড়ির। পুজোয় এরা সব আসে। বুনির গলা, কমল কাকা – নিকু জ্যাঠা….এর মধ্যে কানুর গলাও ….মা’র গলা। মা উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। কি বলছে! সব যেন থেমে গেল। দরজাটা নড়ছে। দরজায় কিছু দিয়ে চাড় দিচ্ছে। দরজাটা কব্জা থেকে ছাড়িয়ে দিল। সবাই আমার দিকে কেমন ক’রে দেখছে! মা কাঁদছে, শব্দ পাচ্ছি না তো! মা ট’লে গেল,কমল কাকা ধ’রে নিল। আমার বুকের ওপর মা মাথা রাখল কেন? কাঁধ দু’টো আঁকড়ে ধ’রেছে। আমি কি শুয়ে আছি! যাঃ শালা…. এটা অতীত বর্তমান না ভবিষ্যৎ!? না কি এটাও ঘটমান বর্তমান!

                                


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দুর্গাপুজোর সাত কাহন

আলয়

এসপার-ওসপার